Pages

Saturday, December 27, 2014

মিরণজাইয়ের অশ্রু।।


ইকরাম তা'জ
(পশতু ছোট গল্প)

গুল চাগতাইয়ের আনার বাগানটা মিরণজাইয়ের মতোই বয়সের ভারে শীর্ণ। তার পরও বসন্ত এলে ডাল পালা সব  হলদে আর সোনালী কুড়িতে ভড়ে উঠে। ফুল ফোটে। ফল ধরে। অপুষ্ট সে ফল খুব বাড়ন্ত নয়।  বুলবুলির ঝাক দল বেধে এসে নষ্ট করে দিয়ে গেলেও আজ আর তাড়াবার তাগিদ নেই কারো।
তাগিদ একটা আছে তার নিজের।  কারোও জন্য অপেক্ষা করা। কখনো সক্কাল অথবা  সারাটা দুপু্র সে গাছের নীচে তাকিয়াটায় শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়।  পথের দিকে দৃষ্টি ফেলতে ফেলতে ঘোলাটে হয়ে আসে দু চোখ। হ্যা ওই তো সেই পথ। কান্দাহার থেকে হেরাত, গজনী, হেলমান্দ সব গিয়ে মিশেছে এক যায়গায়। কাবুল ! কাবুল ! কাবুল !

কাবুলের হাওয়াই আড্ডাটাকে এখন  তার বড় দুষমন মনে হয়  !  পাচ পাচটা জোয়ান ছেলেকে  হাড়িয়ে  এমনিতেই শোকে পাথড়।  শেষ পর্যন্ত বেঁচে ছিল একমাত্র বিটি। দখতার রেজাই। মহাম পষচে বে গোফতান। বিবির রেখে যাওয়া শেষ নিশান। সেও  চলে গেলো একদিন ওয়াতান ছেড়ে।
যে দেশ তার মেয়ের যোগ্য সম্মান টুকুও দিতে পারলোনা। তার  আর সে দেশে থেকে কি হবে ? 

কিন্তু ও তো একা নয়; আরো অনেকেই আজ দেশ ছাড়া। কানুন ওঠে গেছে। নিরাপদ কেউ আর নাই। শিক্ষা এখন যেনো আফগানদের অভিশাপ হয়ে ফলেছে।

কিন্তু তাই বলে------মেয়ে তার ইংরাজ মুল্লুকে !
যে ইংরাজ তার কলজেকে একদিন কেটে দু ভাগ করে দিয়েছিল, সেই ইংরাজের মুল্লুক।

ইংলিস্তান। ইংলিস্তান। ইংলিস্তান।
এভাবে একই কথা বিড় বিড় করে বার কয়েক আওরানো তার ইদানিংকার অভ্যাস হয়ে গেছে।
ইংরাজ !
সারা আফগানীর দুষমন।
হিন্দুস্তান জবর দখলে নিয়ে আফগানকেও কব্জা করতে এসেছিল। জবরদস্তি হলো। ইংরাজের জানে মালে অনেক লোকসান হলো। আবার জিত হলো। আবার হার। হারের প্রতিশোধ। তার নিজ শহর কান্দাহারকে টুকরো করে ভাগ করে দিয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে। আধা কান্দাহার আর সবটা পেশোয়ার আজ পরদেশ-পর মুল্লুক !
তার কলজেকে দুভাগ করে দিয়ে গ্যাছে। 
জং আর জং আর জং। বিরামহীন জং। ইংরাজ-রুশ-আমরিকার জং।
আরব পারসিক আর রাওয়ালপিন্ডির গাদ্দারদের ষড়যন্ত্র লড়াইয়ের আগুনকে আরো উস্কে দিলো।

জীবন আর মৃত্যু; দু'য়ের মাঝে কীইবা ফারাক ? কোনই ফারাক নেই। না নেই। যে জীন্দা আছে,  সে মুর্দ্দা  হতে কতোক্ষণ ! চান  মুহূর্তই যথেষ্ঠ !  
তাই বলে পাঁচ পাঁচটা ছেলেকেই তার হারাতে হবে ? 
এটা কতো বড় আঘাত!
একের পর এক মউতের খবর; বিবি তার পাগল হয়ে গেলো।

বাদশা খান।
সরদার  দাউদ খান।
তার জামানায় অনেক তরিক্কি হয়েছিল আফগান মুল্লুকের।
সেই সাথে মিরণজাইয়ের পরিবারেরও ।
ভালো না মন্দ সে বুঝতে চাইতো না।  তরিক্কি হচ্ছে এইটা বুঝতো। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি বদলে ফেলার চেষ্টা  অনেকের  ভালো লাগেনি। অউরাতদের তরিক্কি অনেকের পছন্দ হয়নি।

তাই বলে সে আজ পর্যন্ত কোনও অশান্তি - হাংগামায়  নিজেকে জড়ায়নি। কারো প্রতি নির্দয় হয়নি। জান পরাণ দিয়ে ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ায় মদত করেছে।
আফিমের জিরাত ছেড়ে আনারের আবাদ  করেছে।
পূর্বপুরুষদের জাত পেশা ছেড়ে ভালো সমাজের কাতারে দাড়াতে চেয়েছে।
গোত্রের সবাইকে ভালো হতে ভালো পরামর্শ দিয়েছে।

বড় বেটা ইলম নিতে গেলো পড়শি মুল্লুক সমরকন্দে।
সাহেবদের মতো  লিবাসে  ফিরে এলো। পারচাম, পারচাম করে সারাক্ষণ জান দিতো ! কতো করে বুঝানো হলো। জোয়ান মর্দ। ইলমদার।  কাজে কর্মে লেগে যাও, তার পর নিকাহ্ করো। সংসার বানাও।
সব ওলট পালট হয়ে গেলো। খোদার কসম; তার কোন সন্তান এমন গোনাহ্ করতে পারে; ভাবাটাও যে অন্যায়। কেউ বলে বেটা তাঁর গাদ্দার। ওয়াতানের দুশমন। নাহ্ মীরণজাই একথা কখনো বিশ্বাস করবে না। একজন পাশতু হয়ে সরদারের বীরুদ্ধে যাবে কোন দুঃখে।  হেরাত হয়ে কাবুল থেকে লাশের পর লাশ আসতে লাগলো।  খোস্ত, কান্দাহার, পান্জশীর, হেলমান্দ, বাগরাম ।  সব শহর ভরে গেলো মানুষের লাশে।  
কী খবর ?
রেডিও কাবুলঃ  সরদার দাউদ খান ক্ষমতাচ্যুত ।  রহম করো ইয়া খোদা; রহম করো। আর কতো খুন খারাবি। এই মাটি তো হিন্দুস্তানের মতো সেঁওতা মাটি নাই । এই মাটি শুখ্যা, খুন পিয়াসী ।  একবার খুনের স্বাদ পেলে আরো পিয়াসা বেরে যায়।
ফরহাদজাই লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল।
তার খুনিরা গিয়ে  গদিতে বসলো।
কুনার থেকে খবর এলো। রুশ ফৌজ সারাসার সারহাদ ছেয়ে গ্যাছে। আমু দরিয়ার পার ঘেষে তাবু ফেলছে।
এরপর কী হতে যাচ্ছে কোনও পাঠানেরই সাধ্য নেই যে আন্দাজ করে।  কিংবা আন্দাজ করতেও যেনো আজ কষ্ট হচ্ছে।
রেডিও কাবুলই সব আন্দাজ পাল্টে দিতে পারে !
সকালের খবর বললো নুর মোহাম্মদ তারাকীর কথা  রাতেই হাফিজুল্লা আমিন ! এরপর বারবাক কারমাল।
রক্তপাত থেমে নেই। কখনো এক একটা খচ্চর বা গাধার পিঠে লাশ আসে।  ভুল ঠিকানায়। বা ইচ্ছা করেই কেউ করে। বেওয়ারিশ লাশের মতো বেওয়ারিশ গাধা কিংবা খচ্চরের পিঠে পচা গলা লাশ !
মানুষেরও আর হুশ থাকেনা। এতো লাশ। লাশ আর লাশ। কোত্থেকে আসে তার কোন হদিস নেই।
কান্দাহারের  জোয়ানরা সব কাবুলের দিকেই যাচ্ছে। কেউ বা পারচামের,  কেউ বা ভিন্ন মতের। আজ ওয়াতনকে রক্ষার তাগিদে সবার একটা বুঝা পড়া হবে। আর রক্তপাত চাইনা। কিন্তু  কে কাকে বিশ্বাস করে ?  অবিশ্বাস  আর সন্দেহের জেরে সব ভেস্তে যেতে বসেছে। কথায় কথায় খুনো খুনি। রক্ত ঢেলে ঢেলেও কারো মন ভেজাতে পারছে না। খাইবারে রুশদের প্রবেশকে ইংরাজ  আমরিকীরা কেউ ভাল চোখে দেখবে না। আর পরশীদের বাড়তি নাক ডুবানো আফগানদের দুর্দশাকে আরও ভারি করে তুলবে। পাহাড় আর উপত্যকা জুড়ে ছুটছে  আগুনের ফুলকী। কামানের কান ফাটা গর্জন। দেশ জুড়ে লড়াই, আর লড়াই।  খুন আর গুম হয়ে যাওয়া মানুষের এক লামহাই কাতার, ফিরিস্তি দিনকে দিন লম্বা হতে থাকলো।  সেই কাতারে যোগ হলো নিজ সন্তান জামশেদ জাই।   রুস্তম...নসর...নুরান....  হায় নসীব ! শোকে শোকে বিবিও শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে চীরতরে গেলো। তার সব  শেষ !

পথের দিকে চেয়ে চোখ ঘোলাটে আর স্থির হয়ে গেছে।  দুপুরের তাতানো রোদে  সড়কের কালো পীঠ বেয়ে তাপের ঢেউ এক অদ্ভুত ধোয়াশার মতো একটা আবছা  কুয়াশার পর্দা ফেলে ।
সেই ধোয়াশার মাঝে প্রতিদিনই সে দেখতে পায়  তার  মেয়ে আর পাঁচ  জোয়ান মর্দ্দ আটকে আছে  স্থির হয়ে। সামনে পিছনে কোন দিকেই  ফিরে যেতে পারছেনা। তাদের সবাইকে  একদিন পর্দা ভেদ করে  আসতে দেখবে বলে প্রতিদিন অপেক্ষা করে যায়। আজ কেনো জানি মনে হলো  ঐ পথ দিয়ে কেউ আর ফিরে আসবেনা। কাবুলের দিকে গেলে কেউ আর  ফিরেনা।  
আশা ভংগের দুঃখে মিরণজাইয়ের দু  চোখ আরো  ঝাপসা হয়ে এলো।
হঠাত তার পেছনে দূরের দহলিজ থেকে জেনানাদের আনন্দ হল্লা শোনা গেলো।
সেই সাথে কার্তুজ ফুটানোর শব্দ।
শিশুর কান্নার আওয়াজে হুশ হলো.....পশতু কওমে  ওয়াতানের জন্য খুন দিতে আরেকজন এলো  !

মিরনজাইয়ের দূ  চোখ থেকে দু ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

Tuesday, December 2, 2014

এক্সট্রা মাইল্ড।

এক্সট্রা মাইল্ড।
তাতেই ফুস ফুস থেকে  বেসু্রে শব্দ বেরোচ্ছে।
পুঁ পুঁ শো শো; এ শব্দ শুনলে যে ডাক্তার তার কান খাড়া করে শুনতেন, তিনি বেঁচে নেই।

ছোট বেলায় শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গার সুতো খালে কুচো চিংড়ি ধরার ছলে খুব করে ডুবাতাম।
চোখ লাল হয়ে যেতো। দু হাত চেপে একটা ছড়া কাটতাম।
 'কাউয়া লো, কুলি লো--- তোদের চোখ রাঙা, আমার চোখ দুধের ফোটা।
যতোক্ষন না আরেকজন বলতো 'কালা গাইয়ের ধলা দুধ, হাড়ি ভাংগে ঠাস্ ঠুস ! ততোক্ষণ একই ছড়া।
ভয় পেতাম একজনকেই। আমাদের আম্মা।
----দেখি এই দিকে আয়।
হাত পড়তো কপালে।
সাবাস্। ...জ্বর ! 
কতক্ষণ ডুবাইছস ?
এর কোন উত্তর নেই। ই উত্তর না দিতে পারাটাই ছিল আমার জন্য বড় শাস্তি। আর কিছু বলতেন না।
আরেকটা শাস্তি অপেক্ষা করতো। ভাত খাওয়া বন্ধ থাকতো তিন দিন। শুধু বার্লি। সাথে পাতি লেবু্র রস, একটু নুন। 

রবিনসন্স প্যটেন্ট বার্লির নীল কৌটোটা প্রায়ই হাড়ানো (?) যেতো। আবার পাওয়াও যেতো। সে ক্ষেত্রে জ্বর সেরে যাওয়া পর।  সে জন্য আম্মার কোনো অসুবিধে হতো না। " হোমিওপ্যাথি ও পারিবারিক চিকিৎসা" র বই নিয়ে লক্ষন দেখে চিকিৎসা চলতো। বার্লির বিকল্প হতো লাল চালের ভাতের মার।
ভাত খেলেই নাকি টাইফয়েড হয়ে যাবে। 
এখন তো ছাই পাশ কত্তো কিছু গিলেই শরীর নস্ট করছি। 
ডাক্তাররা নিষেধ করেন; শুনি কই! যার কথা শুনতাম তিনি আজ নেই। চলে গ্যেছেন  । 
আর ফিরবেন না কোন দিন। দেখাও হবে না কোনদিন।
আবার হতেও পারে, কে জানে???





Sunday, November 30, 2014

উইকএ্যন্ড সিন্ড্রোম!


আজ ঘুম ভেংগে গ্যাছে ৫ টায়। সচরাচর সাতটায় উঠি । কিন্তু উইকএ্যন্ড এলেই  এমনটা হয়। আমার এই অকাল ঘুম ভাঙ্গার নাম দিয়েছি উইকএ্যন্ড সিন্ড্রোম!
বেশি ভোরে জাগলে নিকোবিট প্যাচ কাজ করেনা। আমার  সিরোটিনেন  লেভেল খুব নীচে  নেমে যায়; তাই বেশি ভোরে জাগা  ডাক্তারের বারন আছে।
কিন্তু এখন আমার নিকোটিন চাই। পাগল হয়ে যাবো।

এত্তো ভোরে কিচেনে পেয়ে গেলাম একজন। অনেক কিচ্ছুতে আমার লজ্জা। কিন্তু এটার বেলায় নেই কেনো ?  থাকলে লাইফটা আরো একটু  বোধহয় ভাল হতো।
এম্নিতেই ইউরোপে নিরাপদে আছি। সুখ তো আপেক্ষিক। অইটার কথা নাই।
আামি একটু বেশী দিন বাঁচতে চাই। তার পরও মনে হয় আমার লাং এ লুকানো আছে ওটা।
সুপ্ত থাকতে পারে নাকি অনেকদিন। ১০ বছর পরও --- একটা মেডিক্যাল জার্নাল লিখেছে।
 
মৃদু মৃদু দুটো টান। লাং টন টনিয়ে উঠল।
এক সপ্তাহের গ্যাপ। কতোটা হিলিং হয়েছিল। সব নিপাত গেলো।

বেন - হেজস এক্সট্রা মাইল্ড, ৮ মি. গ্রা ! তাতেই এই অবস্থা। কী করে বেশীদিন বাঁচবো ? 
বাঁচাটা কী খুব জরুরী ? 
কী জানি। কখনো মনে হয় হ্যা, আবার কখনো না।
ছাই হবে এতো ভেবে।
শনি রবি দুটো  দিন এভাবেই কাটবে । ঘুম ভাঙ্গবে  খুব ভোরে 
তার পর আবার সেই আলসে বিড়াল।

আজ বাইরে বেড়োতে হবেনা। আর ঠান্ডাও নামতে শু্রু করেছে। গেলো রাতে -১।
সক্কালে মেজাজটা ফু্র ফু্রে ছিল। কিন্তু মন থেকে আসলো অন্য গান।

বেদনার।
ধীর লয়ে গলা ছেড়ে গাইলাম,
অনেক ক্ষণ ---বার বার একই কলি।
কেন বেদনার গান মনে আসলো ? 

এটা নিয়ে ভাবতে বসলাম।

''মন তুমি আমার কাছে কী চাও ?  কী দুঃখ চেপে আছ ?' 
তোমাকে আজও বুঝলাম না।
কী চাও তুমি আমার কাছে ? 
সুখেরও নাকি অসুখ আছে!  হয়তো বা সেই অসুখ।''

'যতো দূরে, দূরে, দূরেই যাবে বন্ধু
একই যন্ত্রণা পাবে,
একই ব্যথা ডেকে যাবে।।
নেভা নেভা  আলো,
যতো বার জ্বালো
ঝড়ো হাওয়া লেগে তার
শিখা  নিভে যাবে

যতো দূরে, দূরে, দূরেই যাবে বন্ধু-----।'

গানটা পূরবী রাগের; গাইতে হয় পড়ন্ত বিকেলে! ? কী অদ্ভুত না!

নাহ, মোটেই বোধ হয়  অদ্ভুত না ; জীবনেরও শেষ আছে
আয়ুর ও পড়ন্ত বিকেল  আছে
হয়তো সে বিকেলের কাছা কাছি  চলে এসেছি!